বাজেট কি? কেন করা হয়? আয়-ব্যয়ের হিসাব কিভাবে হয়? বাজেট ভালো হয়েছে নাকি খারাপ কিভাবে বুঝবেন?
এই মাসে আপনি কোথা থেকে কত টাকা আয় করবেন, কত টাকা ব্যয় করবেন,কাকে কত টাকা দিবেন, কিভাবে আপনার ব্যয়
কমাবেন? এই হিসাবই হলো আপনার ব্যক্তিগত বাজেট।
সরকার জাতীয় বাজেটেও সেই কাজটাই করেন। তবে ব্যক্তিগত বাজেটে যেখানে মাসে হিসেব করা
হয়, জাতীয় বাজেটে হিসাব ধরা হয় এক বছরের জন্য। জাতীয় বাজেটের অর্থ বছর
শুরু হয় প্রতি বছর পহেলা জুলাই থেকে পরের বছরের ৩০ শে জুন পর্যন্ত।এই সময় সরকারের
প্রত্যাশিত আয় কত হতে পারে, এবং কোন কোন সম্ভাব্য
খাতে তা ব্যয় হবে এই হিসেবই হলো বাজেট।
তবে ব্যক্তিগত বাজেটের সাথে জাতীয় বাজেটে বড় একটি পার্থক্য রয়েছে, ব্যক্তিগত বাজেটে প্রথমত আয়ের হিসেব করা হয় এবং সেই আয়ের উপর ভিত্তি করে ব্যয়ের খাদগুলো ঠিক করে, কিন্তু জাতীয় বাজেট এর ঠিক উল্টা, সরকার আগে ব্যায়ের খাদগুলো নির্ধারণ করে পরে কোন কোন খাত থেকে সেই পরিমাণ আয় করবে তা পরিকল্পনা করে।
অর্থাৎ দেশের বাজেটের ক্ষেত্রে আয় বুঝে ব্যয় নয় বরং ব্যয় বুঝে আয় হয়, জুনের প্রথম সপ্তাহে অর্থমন্ত্রী সংসদের প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করেন জুনের ৩০ তারিখের মধ্যে সংসদে ভোটের মাধ্যমে প্রস্তাবিত বাজেট পাস হয়, এরপর রাষ্ট্রপতি সম্মতিতে বাজেট কার্যকর হয়, নতুন বাজেট ঘোষণার পর সেপ্টেম্বর থেকে পরের অর্থবছরের বাজেটের কাজ শুরু হয়, এজন্য অর্থ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট অন্যসব মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় পরিকল্পনার কাজ শুরু করে।
সরকারের সম্ভাব্য ব্যয়ের খাত :
সরকার বিভিন্ন খাতে ব্যয় করে থাকে এর মধ্যে কিছু খাত উন্নয়নমূলক এবং কিছু উন্নয়নমূলক, যেমন কৃষি ও শিল্প স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি শিক্ষা ও প্রযুক্তি, পানি সম্পদ, গৃহায়ন, শ্রম ও জনশক্তি, মহিলা ওযু উন্নয়ন হল উন্নয়নমূলক ব্যয়ের খাত,সহজ করে বললে এই যে রাস্তাঘাট সেতু স্কুল কলেজ হাসপাতাল নির্মাণ হচ্ছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন হচ্ছে গ্রামীণ উন্নয়ন হচ্ছে এগুলো এই উন্নয়নমূলক ব্যায়েরই অংশ, এসব খাতে ব্যয় করলে দেশ ও জনগণের উন্নয়ন হয় এবং সরকারের আয় বারে, এক কথায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যায়।
এ কারণে সরকার প্রতিবছরের বাজেটে নানা উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নেয় এবং তা বাস্তবায়নে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থ জোগাড় করে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি এডিপি নামের একটি প্রকল্প খাতে এই উন্নয়ন বাজেটের খরচ দেখানো হয়। অন্যদিকে অউন্নয়নমূলক ব্যয়ের খাত গুলো হল জনপ্রশাসন, প্রতিরক্ষা, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা, বিনোদন, সংস্কৃতি, ধর্ম, পেনশন ,ভর্তুকি ঋণ ও ষুধ পরিষদ।
এগুলো অউন্নয়নমূলক খাত কারণ এসব খাতের ব্যয় করলে সরাসরি কোন উন্নয়ন হয় না। ব্যায়ের হিসেবে সরকার তেমন আয় বা মুনাফা করতে পারেনা। কিন্তু দেশ রক্ষা ও প্রশাসন পরিচালনায় সরকারকে এই ব্যয় করতেই হয়। অউন্নয়ন খাতের ব্যায় খুব একটা পরিবর্তন হয় না এজন্য বাজেট করার সময় সরকার এই উন্নয়নমূলক খাতে আগে ব্যায় করে, তারপর বাকিটা দিয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে।
সরকারের প্রত্যাশিত আয়ের খাত :
সরকার মূলত দুটি খাত থেকে আয় করে থাকে, এক কর থেকে আয় এবং দুই কর বহির্ভূত আয়। এরমধ্যে জনগণের দেয়া কর বা ট্যাক্স হল সরকারি আয়ের মূল উৎস, এর মধ্যে রয়েছে আয়কর কর্পোরেট কর, মুনাফা। কারো চাকরি বা ব্যবসা থেকে আয় ও মুনাফা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ছাড়িয়ে গেলে এই কর দেয়া বাধ্যতামূলক হয়ে যায়।
আয় যত বেড়ে যায় কর আরপের হার তত বাড়ে, এছাড়া বিভিন্ন পণ্য কেনা বা সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে নাগরিকদের থেকে কর আদায় করে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট সম্পত্তিকর যেমন ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ নগদ অর্থ, বীমা ইত্যাদি সেই সাথে ভূমিকর যানবাহন কর বিভিন্ন শুল্ক যেমন আমদানি শুল্ক, আবগারি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, নিবন্ধন ও স্টাম বিক্রয়, মাদক শুল্ক, ভ্রমণ কর ও অন্যান্য এই কর থেকে আয়ের মধ্যে পড়ে।
জনগণের থেকে সরকারের এই আয় কে রাজস্ব আয় ও বলা হয়। যা সরকারের স্থিতিশীলায় অর্থাৎ খুব বেশি ওঠানামা করে না। অন্যদিকে কর বহির্ভূত আয়ের মধ্যে রয়েছে ব্যাংক থেকে নেয়ার ঋণের সুদ, সঞ্চয়পত্র, বন্ড, ট্রাজেডি বিল, প্রশাসনিক ফি বা সরকারি সেবার সার্ভিস চার্জ, জরিমানা, দন্ড, বাজেয়াপ্ত থেকে পাওয়া অর্থ ভাড়া ও এজারা টোল ,লেভী, রেলওয়ে, ডাকবিভাগ তার ও টেলিফোন থেকে লভ্যাংশ ও মুনাফা, কিন্তু সরকার যখন দেখে তাদের সম্ভাব্য ব্যয়ের তুলনায় প্রত্যাশিত আয় কম।
সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত কর ধার্য করে অভ্যন্তরীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বন্ডের মাধ্যমে ঋণ করে সেই সাথে বৈদেশিক সাহায্য কিংবা বিশ্ব ব্যাংক আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আই এম এফ, এশিও উন্নয়ন ব্যাংক এডিবি বা অন্যান্য উৎস থেকে বৈদেশিক ঋণ নিয়ে সরকার বাজেটের এই ঘাটতি মেটায়। তবে বৈদেশিক সাহায্য কিংবা বৈদেশিক ঋণ নিতে গেলে তাদের কিছু শর্ত মানতে হয়। কর বহির্ভূত আয় স্থির নয় এটা কম-বেশি হয়ে থাকে।
বাজেটের ভালো-মন্দ :
জাতীয় বাজেট কতটা কার্যক্রম ফলো পশু হবে সেটা নির্ভর করে ওই বাজেটে আয় ব্যয়ের ভারসাম্য আছে কিনা অর্থাৎ সেটা সুষম বাজেট নাকি অসম বাজেট। সরকার জাতীয় বাজেটে যে পরিমাণ ব্যয় করবে সেই পরিমাণ আয়ের সম্ভাব্য খাত নির্ধারণ করতে পারলে সেটাকে সুষম বাজেট বলে।
অন্যদিকে অসম বাজেট হল ব্যয় এর চাইতে আয় কম হলে বা বেশি হলে বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো ঘাটতি বাজেট অর্থাৎ আয় থেকে ব্যয় বেশি হওয়া। সাধারণত উন্নত দেশগুলো সুষম বাজেট প্রণয়ন করে থাকে। ইতালি অস্ট্রেলিয়া এবং সুইজারল্যান্ডে এ নিয়ে রীতিমতো আইন আছে। স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে বিষয়টা ভিন্ন ।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন যে কোন দরিদ্র স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে ঘাটতি বাজেট থাকা স্বাভাবিক বরং এটা উন্নয়নের জন্য ভালো। কারণ দরিদ্র স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলো যদি প্রবৃদ্ধি করতে চায় তাহলে উন্নয়নমূলক খাতে বেশি বেশি ব্যয় করতে হবে। এতে বাজে থাকতে দেখা দেয়।
ঘাটতি বাজেট থাকলে অব্যবহৃত সম্পদের ব্যবহার বাড়ে ঘাটতি পূরণের চাপ থাকে যার কারণে অর্থনীতিতে উদ্দীপনা দেখা দেয় ফলে প্রবৃদ্ধি হতে থাকে। কিন্তু ঘাটতি পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা ভীষণ জরুরি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
জিডিপি হলো একটি দেশের ভেতরে এক বছরে যত পণ্য ও সেবা উৎপাদন হয়েছে তার সমষ্টি। ঘাটতে ঘাটতে হবে এই জিডিপির পাঁচ শতাংশের মধ্যে, এর বেশি হলে দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কা থাকে, আবার ঘাটতি বাজেটের ব্যবস্থাপনাও বেশ জরুরী বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন।
ঘাটতি বাজেটের অর্থ এমন খাতে বরাদ্দ
দিতে হবে যেন তার থেকে আয় এই ঘাটতি এবং এ বাবদ পরিশোধ করা ঋণের সুদের চাইতে বেশি হয়।
এই ঘাটতি ব্যয় মেটাতে সরকার ব্যাংক সহ দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়ে থাকে।