স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস- একটি বিশেষ আলোচনা।

 

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস

উপক্রমনিকাঃ

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস একটি চমকপ্রদ ঘটনা। যার পরতে পরতে  রয়েছে নানান সংঘাত  ও আন্দোলন।  আজ আমাদের এই বিশ্লেষণে আমরা জানবো স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সেই সকল চমকপ্রদ ও আকর্ষণীয় ঘটনা যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা  আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে অতপ্রতভাবে  ভূমিকা রেখেছিল। ১৭৫৭ সালে ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে নবাব  সিরাজউদ্দৌলা বাংলার স্বাধীনতা হারিয়েছিলেন   ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তথা ব্রিটিশদের কাছে কাছে।  পরবর্তীতে নানান ঘাত প্রতিঘাত ও বঞ্চনার মধ্য দিয়ে বাংলাকে অতিক্রম করতে হয় দুইশত বছর। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক সমহারে  চলে নির্যাতন, নিপীড়ন ও বঞ্চনা। ফলশ্রুতিতে রচিত  হয় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন,১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন ও স্বল্পস্থায়ী সরকার গঠন,১৯৬২ সালের শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের বাঙালি মুক্তির সনদ ছয় দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান,   ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন এবং ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা। 

Table of Contents

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসঃ  প্রেক্ষাপট

১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ২৩ বছর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পরিচালিত হয়। এসব আন্দোলনই ১৯৭১ সালে এসে তার চরম পরিণতি হিসেবে সশস্ত্র জনযুদ্ধে রূপ নেয় এবং এক রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। একে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা যুদ্ধ বলা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পটভূমির মধ্যে সামাজিক, রাজনৈতিক, ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নিম্নে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আর্থ- সামাজিক পটভূমি আলোচনা করা হলো :

১. সামাজিক কারণ (Social Cause) : 

পাকিস্তানের দুই অংশের সমাজ কাঠামো ও সামাজিক জীবনযাত্রা প্রণালি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা ৷ একই দেশের অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও ভাষা, শিল্প-সাহিত্য, আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, আবেগ-অনুভূতি সবকিছুই ছিল যেমন আলাদা; তেমনি প্রথা, রীতিনীতি, অভ্যাস, চালচলন, মত ও পথ, চিন্তা চেতনা, ধ্যানধারণা ইত্যাদিও ছিল আলাদা। এক কথায় ধর্ম ব্যতিরেকে সামাজিক কাঠামোর বেশির ভাগের মধ্যেই বিরাট বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। যে কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় অনিবার্য হয়ে পড়ে।

২. মনস্তাত্ত্বিক কারণ (Psychological Cause) : 

পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে অনেক দিক দিয়ে কোনো দিনই মিল ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানরা নিজেদের খাঁটি মুসলমান এবং পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের হিন্দু সম্প্রদায় মনে করত । পূর্ব বাংলার মানুষ মুসলিম জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাকিস্তানে যোগদান করলেও পাকিস্তান সৃষ্টির পর ভাষা, সাহিত্য, জীবনযাত্রা প্রভৃতি বিষয়ে সমস্যা উপলব্ধি করতে থাকে এবং নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য ফিরে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে। ফলশ্রুতিতে তখনই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। তখনই পূর্ব বাংলায় তার তীব্রতা পশ্চিম পাকিস্তান অপেক্ষা প্রকট রূপ ধারণ করে। এতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, পূর্ব বাংলার মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে নিজস্ব স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠা করতে সর্বদা আগ্রহী ছিল। সুতরাং বাংলাদেশ সৃষ্টির পিছনে মনস্তাত্ত্বিক কারণও বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় ।

৩. রাজনৈতিক কারণ (Political Cause) : 

১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে যে পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হয় তার ভিত্তি ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। কিন্তু পাকিস্তান অভ্যুদয়ের পর থেকে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ স্বায়ত্তশাসন বিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হন। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে তাদের উপর অত্যাচার ও নিপীড়নের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় বাঙালি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা পদদলিত হয়, যার ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অনিবার্য হয়ে পড়ে

৪. ভৌগোলিক কারণ (Geographical Cause) : 

ভৌগোলিক দিক দিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো মিল ছিল না ৷ দু'অঞ্চলের মধ্যে সীমানার পার্থক্য ছিল প্রায় হাজার মাইল। আকাশপথ ছাড়া যোগাযোগের কোনো মাধ্যম ছিল না। যোগাযোগের এ দূরত্বের কারণে পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দুঃখ-কষ্ট সম্পর্কে বুঝতে পারত না। তাই এ দু'অঞ্চলের মধ্যে ভাষাগত সামাজিক ও আচার-আচরণের দ্বন্দ্ব লেগেই থাকত ।

৫. অর্থনৈতিক কারণ (Economic Cause) : 

পূর্ব পাকিস্তান ছিল পশ্চিম পাকিস্তানেরদের কাছে উপনিবেশ। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাঙালিদের উপর সীমাহীনভাবে শোষণ করা হয়। রাজস্ব খাতে, উন্নয়ন খাতে, শিক্ষা খাতে, শিল্প খাতে সব জায়গায় অর্থনৈতিক বৈষম্য বিদ্যমান ছিল। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সবচেয়ে বেশি শোষিত হচ্ছিল। ১৯৬২ সালে আইয়ুব শাসনামলে বৈষম্য দূরীকরণের কথা বললেও বাস্তবে এর প্রয়োগ হয়নি। সমগ্র জাতীয় শিল্প সম্পদের ৬০% ছিল পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর বাইশ পরিবারের নিয়ন্ত্রণাধীনে।

৬. সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের অভাব :

পাকিস্তানের রাজনীতিতে সংকট বিরাজ করার মূল কারণসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের অভাব। কারণ পাকিস্তানে কোনো জনগণভিত্তিক রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব গড়ে উঠেনি। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ ছিল সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণির স্বার্থবাদী দল। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে জনগণের স্বার্থ আদায়ের জন্য আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ এর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

৭. রাজনৈতিক বৈষম্য (Political Discrimination) : 

সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ ছিল নিতান্তই অপ্রতুল। পাকিস্তানের কোনো গভর্নর জেনারেল বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব করে নি। কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ বা গণপরিষদে বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব যথাযথ ছিল না। একমাত্র সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভা বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব করলেও কুচক্রী পাকিস্তানিরা তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ১৯৭০ এর নির্বাচনে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও পশ্চিম পাকিস্তানিরা তা মেনে নিতে পারে নি ।

৮. রাজনৈতিক অব্যবস্থা (Political Disorder) : 

পাকিস্তানের স্বাধীনতার দীর্ঘ নয় বছর পর একটি সংবিধান প্রণয়ন করলেও মাত্র দুই বছরের মধ্যেই তা বিলুপ্ত হয় এবং নতুন সংবিধান সম্পূর্ণ সামরিক শাসনের স্বার্থের স্মারক হিসেবে কাজ করে । তাছাড়া ১৯৭০ সালের পূর্ব পর্যন্ত সেখানে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নি। সম্পূর্ণ গায়ের জোরে কোনো প্রকার বৈধতা ছাড়া দেশটিকে চালানো হয়েছে। ফলে দেশটির ভাঙন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে ।

৯. সামরিক ক্ষেত্রে বৈষম্য (Discrimination in military affairs) : 

সামরিক ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে পর্বতসম বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন পদ থেকে নিম্নপদ পর্যন্ত সকল পদেই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রাধান্য। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার প্রশ্ন বরাবরই ছিল উপেক্ষিত। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না। সশস্ত্র বাহিনীর সকল সদর দপ্তর পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত ছিল ৷

১০. প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বৈষম্য (Administrative Discrimination) : 

পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে বাঙালিদের তথা পূর্ব পাকিস্তানিদের অংশগ্রহণ ছিল অত্যন্ত নগণ্য। আবুল মনসুর আহমদ এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন, পাকিস্তান সরকারের ১৯ জন সচিবের মধ্যে একজনও বাঙালি ছিলেন না। ৪ জন যুগ্মসচিবের মধ্যে ৩৮ জন পাকিস্তানি এবং ৩ জন বাঙালি ছিলেন। ১৩৩ জন উপসচিবের মধ্যে ১২৩ জন পাকিস্তানি এবং ১০ জন বাঙালি ছিলেন। আতাউর রহমান খান উল্লেখ করেন যে, কেন্দ্রীয় সরকারের ৪,২০০ জন কর্মচারীর মধ্যে ২,৯০০ জন ছিলেন বাঙালি, যাদের অধিকাংশ নিচু স্তরের, উচ্চপদে ছিলেন না বললেই চলে।  বৈদেশিক মিশনে রাষ্ট্রদূতসহ বাঙালি প্রথম শ্রেণির কর্মচারী ছিলেন ৪৮ জন আর পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মচারী ছিলেন ১৭৯ জন ।

১১. শিল্প ক্ষেত্রে বৈষম্য (Industrial Discrimination) : 

শিল্পক্ষেত্রেও পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয় ৷ পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পায়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। কিন্ত পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়া হয় নি । পাকিস্তানের শিল্প সম্পদের ৬০% ২২টি পরিবারের মধ্যে কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। এ অবাঙালি পুঁজিপতি গোষ্ঠী পাকিস্তানের বেশিরভাগ শিল্প ব্যবসায়ের মালিক। এ কারণে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও আপামর জনতা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। ১২. সাংস্কৃতিক কারণ (Cultural Cause) : পাকিস্তান অভ্যুদয়ের পর ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রথম আঘাত আসে । বাঙালি জনগণ তা প্রতিহত করার জন্য সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভাষা ও সংস্কৃতির আন্দোলন দ্রুতগতিতে স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ নেয় ৷

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসঃ বিভিন্ন পর্যায়

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় সৃষ্টির এক সুদীর্ঘ প্রেক্ষাপট ও ঘটনাবহুল ইতিহাস রয়েছে। স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বাস্তবে রূপ দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার পেছনে অনেকের অবদান রয়েছে ।  বিভিন্ন আর্থ- সামাজিক ও রাজনৈতিক শোষণের শিকার হয়ে এ অঞ্চলের বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।  ৫২'র ভাষা আন্দোলন, ৬৬'র ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯'র গণ অভ্যুত্থান, ৭১'এর সাধারণ নির্বাচন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ সৃষ্টির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটেরই অংশ। নিম্নে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হলো :

১. ভাষা আন্দোলন :

ভাষা আন্দোলন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে আসছিল। পাকিস্তান সরকার এ যৌক্তিক দাবির সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে উর্দুকে একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদ চলতে থাকে যা পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলন নামে পরিচিতি লাভ করে। 

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস

এ আন্দোলন পুনরুজ্জীবিত হয় ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে এবং সেই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্ররা একত্রিত হয়। পুলিশ এ জনসমাবেশের উপর গুলি চালানোর ফলে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরো অনেকে শহীদ হয়। এই ঘটনা আন্দোলনকে এক নতুন মাত্রা দান করে এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব বহুমাত্রায় বাড়িয়ে দেয়। 

১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে চূড়ান্তভাবে সংবিধানে বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি অন্যতম প্রধান জাতীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ভাষা আন্দোলনকে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয় ।

২. ১৯৫৪ সালের নির্বাচন :

পূর্ব বাংলার স্বাধিকার অর্জনের ইতিহাসে ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন ও যুক্তফ্রন্ট গঠনের গুরুত্ব অপরিসীম। মূলত এই যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি মুসলিম লীগ শাসক ও তার দোসরদের শোষণের বিরুদ্ধে একটি 'ব্যালট বিপ্লব'। পূর্ব থেকে ১৯৫১ সালে পূর্বপাকিস্তান প্রদেশিক আইন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও নানা অজুহাতে নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে দেয়। অবশেষে সরকার পূর্ব বাংলায় প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ধার্য করে ১৯৫৪ সালের ০৮ মার্চ থেকে ১১ মার্চ। লক্ষ্য অর্জনে পুরাপুরি সফল না হলেও এ নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক দলগুলো শাসক দল মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যে ঐক্য গড়ে তুলেছিল পাকিস্তানের পরবর্তী জাতীয় রাজনীতিতে এর প্রভাব পড়েছিল সুদূরপ্রসারী।

৩. ১৯৬২ সালের শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন :

ছাত্র সমাজের আন্দোলন নতুন করে গণ-আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়। শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনরত ছাত্র মিছিলের উপর পুলিশের গুলিতে ১৭ সেপ্টেম্বর নিহত হন যার মধ্যে ওয়াজিউল্লা, মোস্তফা ও বাবুল অন্যতম। ছাত্র সমাজের ২২ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে ১৭ সেপ্টেম্বর '৬৩ শিক্ষা দিবস' পালন উপলক্ষে দেশব্যাপী দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠে। রাজনৈতিক দলসমূহ ও বুদ্ধিজীবী সমাজ ছাত্রদের এই আন্দোলনের সবরকম সমর্থন দিয়ে আসে।

৪. ১৯৬৬ সালের ছয় দফা :

১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের পাক-ভারত যুদ্ধ চলাকালীন বাস্তবক্ষেত্রে পূর্ব বাংলা সম্পূর্ণ অরক্ষিত ছিল। পাকিস্তানের সামরিক শাসকগণ সামাজিক, সাংস্কৃতিক নিপীড়ন ও অর্থনৈতিক শোষণের ধারাবাহিকতায় পূর্ববাংলার নিরাপত্তা ব্যবস্থার ন্যূনতম উন্নতি করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেনি। 

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস

বাঙালিদের প্রতি জাতিগত এই বৈষম্যের বাস্তবচিত্র তুলে ধরে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে আহূত “সর্বদলীয় জাতীয় সংহতি সম্মেলনে” বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবি উপস্থাপন করেন। ভাষণে তিনি বলেন, 'গত দুই যুগ ধরে পূর্ব বাংলাকে যেভাবে শোষণ করা হয়েছে তার প্রতিকারকল্পে এবং পূর্ব বাংলার ভৌগোলিক দূরত্বের কথা বিবেচনা করে আমি ৬ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করছি।' পরবর্তীতে এই ৬ দফা দাবি ‘বাঙালি জাতির মুক্তিসনদ' হিসেবে বিবেচিত হয়। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা দাবিসমূহ নিম্নরূপ-

প্রথম দফা : শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি

দ্বিতীয় দফা : কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা

তৃতীয় দফা : মুদ্রা ও অর্থ বিষয়ক ক্ষমতা

চতুর্থ দফা: রাজস্ব কর ও শুল্ক বিষয়ক ক্ষমতা 

পঞ্চম দফা: বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা 

ষষ্ঠ দফা: আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা

৫. আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা:

বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সামরিক বাহিনীর কিছু সংখ্যক সদস্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেমের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের এক প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। সংগঠনের কোনো এক সদস্যের অসতর্কতার ফলে পাকিস্তান সরকারের কাছে এই পরিকল্পনার কথা ফাঁস হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান সরকার সামরিক বেসামরিক ২৮ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। 

১৯ জুন ১৯৬৮ পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে এক রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দায়ের করে। এই মামলা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' নামে পরিচিত। ১৯ জুন ১৯৬৮, ঢাকা সেনানিবাসে এই মামলার বিচার শুরু হয়। বিচার কার্য চলার সময় থেকে শ্লোগান ওঠে- “জেলের তালা ভাঙব- শেখ মুজিবকে আনব'। এই গণ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের জন্য দেশব্যাপী সরকার বিরোধী আন্দোলন পূর্ণতা লাভ করে ।

৬. ১৯৭৯ গণঅভ্যুত্থান:

উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক মুক্তি সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় । এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা আইয়ুব খান সরকারের পতন ঘটে এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। ১৯৬৮ সালের নভেম্বরে ছাত্র অসন্তোষকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়, তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে শহর এবং গ্রামের শ্রমিক-কৃষক ও নিম্ন-আয়ের পেশাজীবীসহ বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষের মধ্যে। অন্তত একটি সাধারণ দাবি আইয়ুবের পতনকে কেন্দ্র করে তৎকালীন পাকিস্তানের সকল অংশের মানুষ একযোগে পথে নামেন।

তবে শিল্পাঞ্চলের শ্রমিক এবং সাধারণভাবে নিম্ন ও মধ্য আয়ের পেশাজীবীদের মধ্যে আন্দোলন ক্রমাগতভাবে শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের রূপ পরিগ্রহ করতে থাকে । পাকিস্তানি রাষ্ট্র কাঠামোয় পূর্ববাংলার জাতিগত নিপীড়ন ও বঞ্চনা এবং তার বিপরীতে ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রামসহ পরবর্তী বিভিন্ন পর্যায়ে গড়ে ওঠা স্বকীয় সত্তার বোধ উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ প্রভাব রেখেছিল। বস্তুত, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা-পরবর্তীকালের সর্ববৃহৎ গণজাগরণ ।

৭. ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচন :

১৯৬৯  সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর হলেও সামরিক সরকার গণ-দাবিকে উপেক্ষা করার মতো শক্তি সঞ্চয় করতে পারেনি। তাই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান সারা দেশে 'এক ব্যক্তি এক ভোটের' নীতিতে সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। ৭ ডিসেম্বর ১৯৭০ থেকে ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭০ এর মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে তফসিল ঘোষণা করা হয় এবং শান্তিপূর্ণভাবে দেশব্যাপী এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। 

নির্বাচনে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ৬ দফা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে রায় প্রদান করে। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে ৩১০ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে জয়লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের ম্যান্ডেট লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক সরকার আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহনা শুরু করে এবং সময়ক্ষেপণ শুরু করে।  বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং আপামর জনগণ এর প্রতিবাদে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে যা স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকেই অগ্রবর্তী হয়।

৮. ১৯৭১ এর অসহযোগ আন্দোলন  :

১৯৭০ সালে নির্বাচনে জয়লাভের পর পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সরকার গঠনে মত দিতে অস্বীকার করেন। একটি রাজনৈতিক দল জনগণের ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠনের ম্যান্ডেট পেয়েছে। তারা সরকার গঠন করবে, এটাই বাস্তবতা। 

কিন্তু সামরিক শাসকগণ সরকার গঠন বা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে এক আলোচনা শুরু করে । আলোচনার নেপথ্যের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বাঙালি রাজনীতিবিদগণ খুব ভালোভাবেই ধারণা লাভ করেন। জাতীয় সংসদের নির্ধারিত অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ১ মার্চ ১৯৭১ দেশব্যাপী অসহযোগের আহবান জানান। সর্বস্তরের জনগণ একবাক্যে বঙ্গবন্ধুর এই আহবানে সাড়া দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে অচল করে তোলে। 

২ মার্চ ১৯৭১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা প্রদর্শিত হয় । ৩ মার্চ ১৯৭১ রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) 'স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ” এর পক্ষ থেকে 'স্বাধীনতার ইসতেহার' পাঠ করা হয়। এই ইসতেহারে 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি” গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

৯. ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ :

৭ মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সমগ্র বাঙালি জাতিকে এক দিক নির্দেশনী ভাষণে সর্বপ্রকার পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত হতে আহবান জানান।  এই ভাষণে তিনি বলেন, “আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল ।

এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।” বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ পৃথিবীতে উল্লেখযোগ্য নেতৃবৃন্দের ভাষণগুলির মধ্যে অন্যতম একটি হিসেবে বিবেচিত। ৭ মার্চের এই ভাষণে বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশ কোনো দলীয় নেতার নির্দেশ ছিল না।

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস

এই নির্দেশ দেশের সর্বস্তরের ছাত্র, জনতা ও বুদ্ধিজীবীদের সাথে বাঙালি সামরিক, বেসামরিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী সকলকেই সচেতন করে তোলে। মূলত বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতির স্বাধীনতার অভীষ্টে পথচলার ক্ষেত্রে ধ্রুবতারার মতো জাজ্বল্যমান একটি শাশ্বত নির্দেশনা। যা বাঙালি জাতিকে আজও উজ্জীবিত করে। হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো তাঁর আহবান মুক্তি পাগল বাঙালিকে মরণজয়ী স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মন্ত্রণা দিয়েছিল।

১০. অপারেশন সার্চলাইট :

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকায় যে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় তা সভ্যতার ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা। নিরীহ এবং নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর 'অপারেশন সার্চলাইট' এর নামে যে আক্রমণ চালানো হয় তাতে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। 'অপারেশন সার্চলাইট' বিষয়ে যে পরিকল্পনা তৎকালীন পাকিস্তান সরকার প্রণয়ন করে তা মূলত একটি সামরিক ব্যবস্থা। 

এটির মাধ্যমে ঘুমন্ত বাঙালিদের উপর সামরিক অভিযানের সূত্রপাত ঘটানো এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আন্দোলনকে শেষ করে দেওয়াই ছিল এর লক্ষ্য ।  ২৫ মার্চের রাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন এবং তার ঢাকা ত্যাগের পর মুহূর্তেই অপারেশন সার্চলাইটের বিভীষিা শুরু হয়ে যায়। 

অপারেশন সার্চলাইট' পরিকল্পনার ভিত্তি হিসেবে দুটি বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়। সুতরাং এতে ধারণা করা যায় যে, পাকিস্তানিদের পরিকল্পনা দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়িত করে বাঙালিদের আন্দোলন ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের স্পৃহাকে দমন করাই ছিল মূল লক্ষ্য।

১১.  স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান ও মহান স্বাধীনতা অর্জন : 

সেনাবাহিনীর হাতে রাত ১২টা ৩০ মিনিটে ধানমন্ডি বাসভবন থেকে বন্দী হবার পূর্বে বঙ্গবন্ধু দলীয় নেতৃবৃন্দকে করণীয় বিষয়ে যথাযথ নির্দেশ দিয়ে অবস্থান পরিবর্তনের কথা বলেন। একই সাথে তিনি বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি সশস্ত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্য বাংলার জনগণকে আহবান জানান।  চট্টগ্রামে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে ঘোষণাটি প্রচারের জন্য পাঠানো হয়।

২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাকে অবলম্বন করে চট্টগ্রাম  আওয়ামী লীগ নেতা এম. এ হান্নান স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। ২৭ মার্চ অপরাহ্নে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ৮ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার আরেকটি ঘোষণা পাঠ করেন।

এই ঘোষণাটিতে তিনি উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে।  তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, নবগঠিত এই রাষ্ট্রের সরকার জোটবদ্ধ না হয়ে বিশ্বের অপর রাষ্ট্রগুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টিতে আগ্রহী। এছাড়াও এ ঘোষণায় সারা বিশ্বের সরকারগুলোকে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলারও আহ্বান জানানো হয়। (তথ্যসূত্র- বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র: মুজিবনগর প্রশাসন, তৃতীয় খণ্ড)। 

৯ মাস রক্তক্ষয়ী সর্বাত্মক যুদ্ধের মাধ্যমে ২৫ লক্ষ শহীদ ও ২ লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের ইতিহাস শেষ হয়।

যবনিকাঃ

পরিশেষে বলা যায় যে, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস একটি বিস্তৃত ও ব্যাপক প্রত্যয়।  নিজের অধিকার ছিনিয়ে আনার জন্য এবং দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে এক সোনালি সংযোজন। এ যুদ্ধে জয়লাভের ফলেই বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।  যার ফলে পূর্ণতা পায় স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস শীর্ষক আজকের আলোচনা।  

 


Post a Comment

Previous Post Next Post