এশিয়ান হাইওয়ে কী? এশিয়ান হাইওয়েতে সংযুক্তির ফলে পুরো এশিয়া অঞ্চলে কী ধরনের পরিবর্তন আসবে- আলোচনা করুন।

এশিয়ান হাইওয়ে

ভূমিকা:

এশিয়ান হাইওয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে শুরু করে ইউরোপ পর্যন্ত যোগাযোগব্যবস্থার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। শিল্প বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধিসহ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আন্তসংযোগ বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এশিয়ান হাইওয়ে এশিয়ার জন্য একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। এর মাধ্যমে এশিয়ার জনগণের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপিত হবে এবং এশিয়ার অর্থনীতি বিশ্বের অর্থনীতিতে চালকের আসনে বসবে।

Table of Contents

এশিয়ান হাইওয়ে:

এক লাখ ৪০ হাজার কিলোমিটার যে এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক হতে যাচ্ছে, তা প্রায় পুরো এশিয়াকে সড়কপথে সংযুক্ত করবে। টোকিও থেকে শুরু করে এই পথটি গিয়ে ঠেকবে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে, এই সড়ক যুক্ত করবে এশিয়ার প্রায় ৩২টি দেশকে। সামনে সেই সম্ভাবনা আরো সম্প্রসারিত হতে পারে। 

এশিয়ান হাইওয়ে

এই সড়ক রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ হয়ে ফিনল্যান্ডের সীমান্ত পর্যন্ত যাবে এমন স্বপ্নও দেখেন অনেকে। এভাবে কোরীয় উপদ্বীপ থেকে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল পর্যন্ত ৫৩টি দেশকে যুক্ত করতে পারে এই সড়ক। ধারণা করা হয় ভবিষ্যতে ইউরোপের সঙ্গে এশিয়া মহাদেশের বাণিজ্য ও যোগাযোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রুটে পরিণত হবে এই নেটওয়ার্ক।

এশিয়ান হাইওয়ের পটভূমি:

এশিয়ান হাইওয়ে ধারণাটি খুব সাম্প্রতিক ইস্যু হিসেবে বিবেচিত হলেও বিষয়টির চিন্তাভাবনা ও রূপরেখা অনেক আগে থেকেই জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন (ESCAP)-এর মাধ্যমে দানা বাঁধতে শুরু করে। আসলে ওই মহাসড়কের চিন্তাভাবনা আজ থেকে প্রায় ৪৫-৫০ বছর পূর্বে CENTO SEATO চুক্তির আওতায় সূচিত হয়। 

এশিয়ান হাইওয়ে

স্নায়ুযুদ্ধের সময় এর কার্যক্রম কিছুটা স্থগিত থাকলেও স্নায়ুযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তি Unipolar Global System And New Economic World Order-এর কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রবর্গ এশিয়ায় তাদের আধিপত্য পাকাপোক্ত করার জন্য এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনীতিক উন্নয়নের ধুয়ো তুলে সুকৌশলে তার নিয়ন্ত্রণাধীন জাতিসংঘ ও এর নানা অঙ্গসংগঠন, বিশেষ করে ESCAP এশিয়ান হাইওয়ে চালু করার জন্য কাজ শুরু করে।

বাংলাদেশের রুট:

বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে এশিয়ান হাইওয়ের ৩টি রুট ঠিক করেছে এসকাপ।

১ম রুট: বেনাপোল দিয়ে প্রবেশ করে যশোর, ঢাকা, কাঁচপুর সিলেট হয়ে তামাবিল সীমান্ত পর্যন্ত।

২য় রুট: বাংলাবান্ধা দিয়ে প্রবেশ করে হাটিকুমরুল, ঢাকা, কাঁচপুর, সিলেট হয়ে তামাবিল পর্যন্ত।

৩য় রুট: মংলা দিয়ে প্রবেশ করে যশোর, হাটিকুমরুল, ঢাকা, কাঁচপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার হয়ে টেকনাফ।

এই তিনটি গতিপথের প্রথম দুটি ভারত থেকে প্রবেশ করে পুনরায় ভারতে শেষ হবে। শুধু ৩য় গতিপথ মিয়ানমার সীমান্তে শেষ হয়েছে। এশিয়ার ২৮টি দেশ ইতোমধ্যে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।

বাংলাদেশের রুট নিয়ে বিতর্ক:

এসকাপের মানচিত্র অনুযায়ী এশিয়ান হাইওয়ের প্রস্তাবিত ১ নম্বর মহাসড়ক প্রবেশ করবে তামাবিল দিয়ে শেষ হবে বেনাপোল সীমান্তে, এবং ২য় মহাসড়ক প্রবেশ করবে তামাবিল দিয়ে শেষ হবে বাংলা বান্ধায়। প্রবেশ ও শেষ দুটিই ভারতের মধ্যে হওয়ায় বাংলাদেশ আপত্তি জানিয়েছে। বাংলাদেশের মতে এই দুটি রুট অনুমোদন করা হলে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। কেননা এক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশকে তাদের করিডোর হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ পাবে।

এশিয়ান হাইওয়ে

এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ৩ নং রুটকে এ এইচ-১ হিসেবে গ্রহণ করার জন্য এসকাপের কাছে আবেদন করলে ভারত প্রবল আপত্তি জানায়, বাংলাদেশের প্রস্তাব UN এসকাপ এখনো মীমাংসা করেনি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হওয়ার জন্য জোড় তৎপরতা চালায়। ২১ মে ২০০৯ সালে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের আন্ত:মন্ত্রণালয় বৈঠকে UN এসকাপের আগের প্রস্তাব অনুযায়ী এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হওয়ার আবেদন জানানোর সিদ্ধান্ত নেয় এবং পূর্বের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।

এশিয়ান হাইওয়ে থেকে বাংলাদেশের সম্ভাব্য প্রাপ্তি:

এশিয়ান হাইওয়ের মাধ্যমে এশিয়ার দেশগুলোকে সংযোগ ঘটানো গেলে বাংলাদেশসহ এশিয়ার অর্থনৈতিক চেহারা পুরোপুরি বদলে যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কেননা সড়ক পথে বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটবে এবং পরিবহন ব্যয় অনেকাংশে হ্রাস পাবে। 

এশিয়ান হাইওয়ে

যার সুফল ভোগ করবে বাংলাদেশ সহ এশিয়ার দেশগুলো। শুধু এশিয়া নয় এই হাইওয়ের মাধ্যমে ইউরোপের সাথে সংযুক্ত হওয়ায় এশিয়ার দেশগুলো লাভবান হবে। এই হাইওয়ে চালু হলে বাংলাদেশ যে সকল বিষয়ে লাভবান হতে পারে সেগুলো হলো:-

১. বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে;

২. আমদানী-রপ্তানী বাণিজ্য পরিবহন ব্যয় হ্রাস পাবে;

৩. যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন ঘটবে;

৪. পণ্য পরিবহণের সময় হ্রাস পাবে;

৫. সীমান্তের প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে অবৈধ চোরা কারবার হ্রাস পাবে;

৬. আঞ্চলিক সম্পর্ক দৃঢ় হবে;

৭. আমদানী পণ্যের দাম/মূল্য হ্রাস পাবে; এবং

৮. পরিবহন থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব থেকে দেশ উপকৃত হবে।

উপসংহার:

উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি, এশিয়ান হাইওয়ে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি মাইলফলক। যদি এশিয়ান হাইওয়ের রুটগুলো সঠিক ও নির্ভুলভাবে তৈরি করা যায়, তাহলে এশিয়ার অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাবে। এশিয়ার অর্থনীতি বিশ্বের যেকোনো অর্থনীতির চেয়ে বেশি কার্যকর ও গতিশীল হবে।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post