জাতীয়তাবাদ কী? বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশধারা আলোচনা কর।
সমাজ ব্যবস্থার আদিকাল থেকেই মানুষ একতাবদ্ধ হয়ে বসবাস করে আসছে। তারপরও পৃথিবীতে সব মানুষই বাহ্যিক দিক থেকে সমান তবুও এক এলাকার মানুষের কথাবার্তা, চালচলন থেকে শুরু করে সবকিছুতেই অন্য আরেক এলাকার মানুষের সাথে পার্থক্য লক্ষ করা যায় । আর এই পার্থক্য বা ভিন্নতার মূলে যে জিনিসটি কাজ করে তা হচ্ছে জাতীয়তাবাদী চেতনা। কেননা একমাত্র জাতীয়তাবাদই হচ্ছে জনগণের ঐক্যবদ্ধতার ভিত্তি।
জাতীয়তাবাদ কী?
জাতীয়তাবাদ হচ্ছে মানুষের চরম ও পরম আত্মিক ধারণা এই ধারণার ভিত্তিতে এক মানবগোষ্ঠীকে অন্য মানবগোষ্ঠী থেকে স্বতন্ত্র করা যায়। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদের মূল বৈশিষ্ট্য দুটি হলো— ১. নিজস্ব ঐক্যবোধ এবং ২. পৃথিবীর অন্যান্য জনসমাজ থেকে স্বাতন্ত্র্যবোধ । সুতরাং জাতীয়তাবাদ হচ্ছে এমন এক মানসিক অবস্থা বা চেতনা যার দ্বারা কোনো জাতি স্বজাত্যবোধ এবং স্বকীয়তার ভিত্তিতে নিজেদেরকে অন্য জাতি থেকে পৃথক মনে করে এবং এই স্বকীয়তাকে কেন্দ্র করে একটি আবেগ, অনুভূতি ও আত্মিক পর্ব ধারার সৃষ্টি হয় ।
অধ্যাপক হ্যান্স কোন এর মতে, “জাতীয়তাবাদ প্রথম এবং চূড়ান্তভাবে
গঠিত একটি মানসিক অবস্থা এবং এটি একটি চেতনা বিশেষ । জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি
করেই কেবল কোনো রাষ্ট্রের জন্ম ঘটে এবং জাতীয়তাবাদ ছাড়া রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে
না । বংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।”
জাতীয়তাবাদ হতে পারে আঞ্চলিক ও রাষ্ট্রীয় । বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পিছনে যে
জাতীয়তাবাদ কাজ করে তা হচ্ছে ভাষাগত জাতীয়তাবাদ। বাঙালি জনগণ নিজেরা ঐক্যবদ্ধ
হয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয় এবং বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে এ
জাতীয়তাবাদ বিকাশ লাভ করতে সক্ষম হয় ৷
বাঙালি
জাতীয়তাবাদের বিকাশধারা বা বাংলাদেশ সৃষ্টির ঐতিহাসিক পটভূমি:
জাতীয়তাবাদ কোনো আকস্মিক বিষয় নয়।
সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় নানা রকম ঘাত প্রতিঘাত ও প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে
জাতীয়তাবাদী চেতনার উদ্ভব ঘটে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর সাহিত্য
ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে বাংলাদেশি তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়। তাছাড়াও
রীতিনীতিগত ঐক্য, ভৌগোলিক ঐক্য, ধর্মীয় ঐক্য প্রভৃতি উপাদানও বাঙালি
জাতীয়তাবাদ সৃষ্টিতে উৎসাহ জাগিয়েছে। নিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশধারা
আলোচনা করা হলো-
১. ভাষা আন্দোলন:
স্বাধীন সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্র
জন্ম নেওয়ার পর থেকেই বাঙালি জনগণের অধিকারের প্রশ্নে পশ্চিম পাকিস্তানি
শাসকগোষ্ঠী শুরু করে নানা রকম টালবাহানা। প্রথম আঘাত আসে বাঙালিদের ভাষার ওপর।
স্বাধীন পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা নিয়ে পাকিস্তানি
শাসকগণ নানা রকম কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিয়ে উর্দুকে
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। কিন্তু বাঙালি এ ষড়যন্ত্রের
বিরুদ্ধে তথা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ভাষা আন্দোলন
চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে। এ দিন এদেশের ছাত্র সমাজ
রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেয় বাংলা ভাষার দাবিতে। তাই ভাষা আন্দোলন সর্বপ্রথম
বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
২. '৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন:
বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের দ্বিতীয় পর্যায়
হচ্ছে '৫৪-র প্রাদেশিক নির্বাচন। ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে আসন্ন প্রাদেশিক
নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে শিক্ষা দিতে কয়েকটি সমমনা দলের সমন্বয়ে
যুক্তফ্রন্ট নামে একটি বিরোধী জোট গঠিত হয়। এই নির্বাচনে বাংলার জনগণ পাকিস্তানি
শাসকগোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। ফলে এই নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে
যুক্তফ্রন্ট ২৩৬টি আসনে বিজয়ী হয়। এই নির্বাচনে বিজয়ী যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন
করে। পূর্ব পাকিস্তানের যথার্থ প্রতিনিধিগণ এদিন গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা
করার দাবি উত্থাপন করেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি
প্রদান করা হয়। তাই বলা যায়, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের বিজয় বাঙালি জাতীয়তাবাদকে
আরো একধাপ অগ্রগামী করে ।
৩. '৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন:
পশ্চিম পাকিস্তান শাসক চক্র বরাবরই
পূর্ব বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করতে সর্বাত্মক করেছে। তাদের ভয় ছিল বাঙালিরা
শিক্ষায় উন্নতি লাভ করলে পাকিস্তানের চাকরি ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী করতে হবে।
১৯৬৩ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যয় ছিল ২০৩ কোটি টাকা, পঁচাত্তরে পূর্ব
পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ৭৬.৫ কোটি টাকা। এ ব্যবধানের জন্য পূর্ব বাংলার
জনগণ বিভিন্ন আন্দোলন করেছিল । যা জাতীয়তাবাদের বিকাশকে সুগম করে।
৪. ১৯৬৬-এর ছয় দফা:
বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে দ্বিতীয়
গুরুত্বপূর্ণ স্তর হচ্ছে ১৯৬৬ সালের ছয় দফা দাবি। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর
রহমান সর্বপ্রথম ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিতব্য বিরোধী দলগুলোর
সম্মেলনে ছয় দফা দাবি পেশ করেন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের ব্যাপক প্রচারণায় ছয়
দফা দাবি হয়ে ওঠে বাংলার আপামর জনসাধারণের প্রাণের দাবি। ছয় দফাকে বঙ্গবন্ধু
বাংলার মানুষের মুক্তির সনদ হিসেবে অভিহিত করেন । তাই পরবর্তীতে ছয় দফাকে কেন্দ্র
করে শুরু হয় স্বাধিকার আন্দোলন । যা বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের পথকে সুগম করে ।
৫. আগরতলা মামলা:
১৯৬৮ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী
বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরোও ৩৪ জনের নামে পাকিস্তানকে
বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রের নাম দিয়ে ১৯৬৮ সালে আগরতলা মামলা দায়ের করে। কিন্তু
বাংলার জনগণ পাকিস্তানিদের এই ষড়যন্ত্র বুঝতে পারে এবং এজন্য পাকিস্তানিদেরকেই
দোষারোপ করে শুধু তাই নয় এ সময় বাংলার জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে রাস্তায় নেমে
আসে এবং শেখ মুজিবসহ সবাইকে মুক্তি দিয়ে আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের জন্য ব্যাপক
আন্দোলন গড়ে তুলে- তা জাতীয়তাবাদকে আরো শক্তিশালী করে।
৬. '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান:
বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে আরেকটি
গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হচ্ছে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান। আওয়ামী লীগের ছয় দফা ও
ছাত্রসমাজের ১১ দফা উপেক্ষিত হলে ১৯৬৯ সালে গোটা দেশব্যাপী আইয়ুব বিরোধী তীব্র
আন্দোলন শুরু হয়। কিন্তু সরকারের গ্রেফতার, গুলি, নির্যাতন সবকিছু উপেক্ষিত হয়ে
বাঙালি গণআন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। এই আন্দোলনের ফলে জাতীয়তাবাদ বিকাশের
পথ সুগম হয়।
৭. '৭০-এর সাধারণ নির্বাচন:
পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে '৭০ এর
সাধারণ নির্বাচন ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীনতা
লাভ করার পর ১৯৭০ সালেই প্রথমবারের মতো সমগ্র পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত
হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অংশগ্রহণ
করে। বাংলার জনগণ এদিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয় । এই নির্বাচনের
মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, বাংলার জনগণ পাকিস্তানি নয়, বরং বাঙালি নেতৃত্বের
অধীনে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে দেশ গড়তে চায়। এই নির্বাচন বাঙালি
জাতীয়তাবাদে পূর্ণতা এনে দেয়।
৮. ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন:
১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ পূর্ণ জনসমর্থন
নিয়ে বিপুল ভোটে জয়ী হলেও পাকিস্তানি সরকার আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর
করতে নানারকম অজুহাত দাড় করাতে থাকে । এর প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭
মার্চের ভাষণে অসহযোগ আন্দোলন বেগবান করার আহ্বান জানান। এ অসহযোগ আন্দোলন একময়
গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় বাঙালিরা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র
প্রতিষ্ঠার জন্য রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। দীর্ঘ নয়মাস যুদ্ধের মধ্য
দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়, যা সম্ভব হয়েছিল কেবলমাত্র
জাতীয়তাবাদের কারণেই। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭২ সালের সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে
অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা
যায় যে, কোনো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদই হচ্ছে একমাত্র ভিত্তি ।
বাঙালিরা ভ্রাতৃত্ববোধের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয় এবং নানা ঘটনার
পরিপ্রেক্ষিতে এই জাতীয়তাবাদ বিকশিত হতে থাকে এবং স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশ
প্রতিষ্ঠা বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বাস্তব রূপ প্রদান করতে সচেষ্ট হয়। স্বাধীন
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রধানতম উৎস ছিল জাতীয়তাবাদ।